বই দিতার ঘড়ি
লেখক দীপেন ভট্টাচার্য
দিতার ঘড়ি একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস।
একজন জ্যোতিঃপদার্থবিদ এবং অধ্যাপক যখন একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস লেখেন তখন সাহিত্যের মহাবিশ্বে অগণিত মহাবিশ্বের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তার মধ্যে যে দুটি প্রধান সম্ভাবনা থাকে তার একটি হল তত্ত্বের মাথা-ধরানো কচকচি সহ একটি বিজ্ঞান-বেশি সাহিত্য-কম সাহিত্যের আর অন্যটি, যার সম্ভাবনা কম হলেও অবশ্যই থাকে, সেটি হল একটি বিজ্ঞান-রসে জারিত মুচমুচে গদ্য সাহিত্য।
এই বইটি এই দ্বিতীয় সম্ভাবনার পরিপূর্ণ উদাহরণ।
লেখক ডঃ দীপেন ভট্টাচার্য, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যারিল্যান্ড-এ নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা রশ্মি জ্যোতি জ্যোতিঃপদার্থবিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশূন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন।
বর্তমানে পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কমিউনিটি কলেজে; এছাড়া পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মোরেনো ভ্যালি কলেজে।
এই উপন্যাস ছাড়াও বাংলা ভাষায় তার ভিন্ন স্বাদের বেশ কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান বই প্রকাশিত হয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য মৌলিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনীঃ ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’, ‘দিতার ঘড়ি’, 'নক্ষত্রের ঝড়’, 'নিওলিথ স্বপ্ন' ইত্যাদি।
এই কল্পবিজ্ঞান কাহিনিটির অন্যতম উপজীব্য বিষয়বস্তু হচ্ছে সময়। সময় কি? এ প্রশ্ন তুললেই আমাদের মনে পড়ে ঘড়ির কথা। ঘড়ির কাঁটাটি নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে আর কাঁটার অতিক্রান্ত দূরত্ব থেকে আমরা মাপছি সময়।
ঘড়ি যদি বন্ধ হয়ে যায়? কেমন হবে যদি পৃথিবীকে সময়হীন করে রাখা যায়? সময়ের ধারায় বিঘ্ন হলে কি ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার অবতারণা হতে পরে? সেই অবস্থায় ঘড়ি কী দেশ-কাল কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারে?
অনেক উত্তরের বিশাল পাহাড় ভেঙে সমতল ভূমি গড়ে উঠেছিল কোটি কোটি বছর ধরে। বহু শত বছর আগে সেই ভূমিতে বাস করত এক দার্শনিক গোষ্ঠী, তারা আধুনিক সংজ্ঞায় বিজ্ঞানীও ছিল। এই দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের যান্ত্রিক বলা হতো। যান্ত্রিকেরা তাদের কার্যবিধি সমতল ভূমিতে কয়েক শ বছর ধরে রেখেছিল; কিন্তু কালচক্রে, ইতিহাসের সংঘাতে, ধীরে ধীরে সমতল ভূমি থেকে তাদের প্রায় বিলোপ হয়। বহু শত বছর পর সমতলের মানুষ যান্ত্রিক বলে যে কোনো গোষ্ঠী ছিল, সেটা সম্পূর্ণভাবেই ভুলে যায়। তাদের ঐতিহ্যের বিজ্ঞান ও দর্শন একইভাবে হারিয়ে যায়।
কিন্তু যান্ত্রিকরা সম্পূর্ণভাবে সমতল থেকে মুছে যায়নি। হারিয়ে যাওয়ার আগে তারা সমতলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছে। তাদের দূরদর্শিতাই সমতলকে এক গভীর অজ্ঞানতা থেকে বাঁচাতে চেয়েছে। সেই ইতিহাস যতটুকু জানা গেছে, তা-ই এখানে লিপিবদ্ধ করা হলো। এ কাহিনি সমতল ভূমির এক সন্ধিক্ষণের।
কল্পকাহিনিটির উল্লেখযোগ্য চরিত্র ঘড়িনির্মাতা অসিতোপল, তাঁর মেয়ে দিতা, ক্রান্তিক, দার্শনিক মৈনাক, তাঁর স্ত্রী আদ্রিকা, আর কাহিনির প্রধান চরিত্র ত.-যাকে ঘিরে গল্পটি এগিয়েছে।
কোন এক অজানা সময়ে চিতা সামরিক বাহিনী দখল করে রেখেছিলো সমতল ভুমি। তাদের যুদ্ধ ছিলো সমতলের সময় নিরূপণের দর্শনের বিরুদ্ধে, ঘড়ি নির্মাণের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযান ছিলো সময়ের গঠন অক্ষুণ্ণ রাখতে। চিতাদের দর্শন ছিলো- সময়প্রবাহের জ্ঞান অজ্ঞতার নির্দোষ আনন্দকে ধ্বংস করে দেয়। প্রথমে চিতারা নিষিদ্ধ করেছিলো সেকেন্ডের কাটার ব্যবহার, তারপর মিনিটের কাটা, অবশেষে ঘন্টার কাটার ব্যবহার নিষিদ্ধ হলো।তাদের নির্মমতায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো সমতল। সেই সমতলে অতীতে বাস করতেন মনীষী বিজ্ঞানীরা, যাদের যান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করা হতো। এই ভয়াবহ সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য যান্ত্রিকেরা অতীতেই এক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। সমতলকে জয়ী করতে সেই সমাধানের পথে ভ্রমণ করে ত., যার সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে এক মহাবিশ্ব বিভক্ত হয়ে যেতে পারে অনুরূপ কতিপয় মহাবিশ্বে, তাই বিভিন্ন মহাবিশ্বে সমতলের কাহিনির পরিণতিও হয়েছে ভিন্ন।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সমাজের মধ্য দিয়ে একটা সুতোর রেখা টেনে সবকিছু একটা কার্যকারণে আবদ্ধ করতে চান। একশ বছর আগে যে সমাজ এখানে ছিল। সেই সমাজের একটি লোকও তো এখন বেঁচে নেই। আজকের দুটি সমাজ যদি যুদ্ধ করে, একশ বছর পরও কি বাধ্যবাধকতায় তাদের যুদ্ধ করতে হবে? সেই যোদ্ধারা তো এখনো জন্মায়নি! আমরা সমাজকে ভাবি একটা গাছ, যে তার আকৃতি ঠিক রেখে শুধু তার কোষ বদলাবে। কোষ বদলালে যে আকৃতি বদলে যেতে পারে, তা আমরা স্বীকার করি না। তাই আমাদের সমাজ বদলায় না। বিদগ্ধ পাঠক এই বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির রহস্যের বিভিন্ন স্তর উন্মোচন-প্রক্রিয়ায় কৌতূহলী হবেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই কাহিনির যুদ্ধ অতি পরিচিত।
কাহিনীর শুরু এক লেট হওয়া ট্রেনের ঠিক পেছনে ছোটা আরেকটি ট্রেনে। যেখানে যাত্রী আমাদের কাহিনীর প্রটাগনিস্ট ত.
এই ত. বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য বিশ্বে ত১ বা ত২ অথবা ত৩ হয়ে ঘুরে ঘুরে আসবে আমাদের কাহিনীতে। লেটে চলা প্রথম ট্রেনটির শেষ কামরায় বসে ছিল একটি নারী, বছর পঁচিশ-ত্রিশ হতে পারে বয়স, খোলা জানালায় কনুইয়ে ভর দিয়ে হাত দিয়ে মুখমণ্ডলটি ধরে রেখেছিল। আমাদের প্রটাগনিস্ট ত. এর ট্রেনটি তার দৃষ্টিপথে এলেও সে সেই সম্বন্ধে প্রথমে সচেতন ছিল না।
কিন্তু সে সচেতন হবে।
হল।
আমাদের কাহিনী তুরার পাহাড়, সমতল, সমুদ্র, সমুদ্রের ওপারে বিদেশের বিভিন্ন স্থান হয়ে ফিরে ফিরে আসবে তুরার পাহাড়ে এবং সমতলে। খুঁজে বেড়াবে সেই লেট ট্রেনে দেখা মুখটি।
পেরিয়ে যাবে যুগ। আসবে যুগান্তর।
মহাশূন্যের প্রান্তরে দৌড়োবে ত.২, পৃথিবীর ধার ঘেঁষে, সূর্যের চারদিকে এক মহাকালো আঁধারে। তার দুই দিকে যেন দৌড়োবে দিতার সেই দুটি কুকুর, প্রকৃতিতে তাদের পায়ের ছাপ তখন আর দেখা যাবে না। ত. এর হাতে তখন দিতার ঘড়ি জ্বলছে। ত. জানে না কোন সে অজানা মহাবিশ্ব থেকে সংকেত আসছে ঘড়ির কাছে? ভাববে ত.২। সেই মহাবিশ্বকে তার হয়তো কখনোই দেখা হবে না। তার মনে প্রশ্ন জাগবে। অজানা সেই মহাবিশ্বের দিতা কি দশ বছর অতীতের তার মহাবিশ্বের দিতার মতো হবে? সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না। অন্তত আপাতত এই মহাবিশ্বে ভাবে ত.২ সেইরকমই।
ভিন্ন স্বাদের এই বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির রহস্যের বিভিন্ন স্তর উন্মোচন করে পাঠক আনন্দ পাবেন।
পাঠকদের মধ্যে যাদের সময়, কণা, তরঙ্গ সম্পর্কে ধারণা সাধারণ পাঠকের তুলনায় বেশি, সেই সম্ভাবনাময় মহাবিশ্বের পাঠকদের এই বইটির অনেক বেশি আনন্দ দিতে পারার সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে।
এই বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির প্রথম প্রকাশ জুলাই ২০১২
প্রকাশক - প্রথমা
ইবুক প্রকাশক:
বইয়ের হাট পাবলিকেশন্স
আটলান্টা, জর্জিয়া
ইউ এস এ
বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন - এরিক হ্যারিস (Eric Harris)
রিভিউটি লিখেছেনঃ
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।