উপন্যাস এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখনো লিখে চলেছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে। আশি পেরানো মানুষটি আজও কৈশোরের কাছে এক অনাবিল আনন্দের দরজা খুলে দেন। চারপাশে জটিল প্রতিযোগিতাসর্বস্ব জীবনের মধ্যে থেকেও এক সুন্দর বিশ্বাসের জগৎ ভালোবাসার জগতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ছোটদের আনন্দময় মুক্তি ঘটে আর অলক্ষ্যে তাদের মধ্যে তিনি সঞ্চারিত করে দেন এই পৃথিবী এই জীবনের প্রতি ভালোবাসা আদর্শবোধের, তিনি পরিচয় করিয়ে দেন এই স্বার্থসর্বস্ব পৃথিবীতেও কিছু নিতান্ত ভালো মানুষের সঙ্গে; চালাকিসর্বস্ব দ্রুতগতির অতি আধুনিক জীবনের মধ্যেও বেঁচে থাকে যে এক ভালো লাগার পৃথিবী, শীর্ষেন্দুর হাত ধরে সেই পৃথিবীতে ক্ষণিক আনন্দ অভিযান ঘটে তাঁর গল্পের পাঠকদের।
সময়ের সরণিতে এক সময়চারী পথিক সুদুর কালপ্রবাহের ওপার থেকে এসে বর্তমান শতকের পৃথিবীতে মাঝে মাঝে ফেরি করে আশ্চর্য কিছু জিনিস। এমন একটা টর্চ। যাতে আলো জ্বলে না, এমন এক লাট্টু যা লেত্তি ছাড়াই সঠিকভাবে চালালে অনন্তকাল ঘুরে চলে, এমন এক বাঁশি যা বাজে না। অথচ অন্তরালে ঘটে চলে কিছু আশ্চর্য ঘটনা। সেই টর্চ আলো জ্বালায় না, কিন্তু সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে সুদূরের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে অথবা অন্ধকারের মধ্যেই দৃশ্যমান করে তোলে অনেক কিছু । সেই লাট্টুর ঘূর্ণনে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপন্ন হতে থাকে অবিরল। আর সে নিঃশব্দ বাঁশির অশ্রুত তরঙ্গ ক্ষতিকর পতঙ্গদের সরিয়ে দেয় অনেক দূরে। গজপতি একজন ভালোমানুষ বিজ্ঞানী যাকে সাধারণে চিনতে পারে না, তার মর্যাদা দেয় না। বাড়ির ভৃত্য পর্যন্ত অবিরাম ঠকিয়ে চলে যে মানুষটিকে একদিন তিনিই পৃথিবীর দূষণ প্রতিরোধে আশ্চর্যভাবে প্রায় সফল হয়েছিলেন। শুধু ষড়যন্ত্রকারী কিছু মানুষের লোভ আর স্বার্থসিদ্ধির কারণে সে বিজ্ঞান গবেষণা অসময়ে থেমে গেছিল। এই ফেরিওয়ালার তুচ্ছ খেলনাগুলি কোথাও তাঁকে আকর্ষণ করে আর সঠিক মানুষের হাতেই ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের যন্ত্রগুলি যথাযথভাবে কাজ করে। কিন্তু গল্প তো এখানেই থামে না। আধুনিক জটিল জীবনকে কৈশোরের সঙ্গে লেখক পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু অনন্ত রূপকথা বলেন না। তাই এখানে আসে কিছু গুন্ডা প্রকৃতির লোক যারা মানুষের মঙ্গলের বদলে অর্থ ক্ষমতা আর আধিপত্য দখল করতে সেইসব যন্ত্র আত্মসাৎ করতে চায়। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে বর্তমান কালপ্রবাহে নিয়ে এসে ফেলেও এই সুবিধাবাদী লোকদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে শুরু হয় সংঘাত। মাঝখানে চলে আসে শ্যাডোর মতো কিছু মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী অথচ নিরুপায় মানুষ যাদের অভাব ও অসহায়তাকে ব্যবহার করে কার্যসিদ্ধি করতে চায় এসব নিয়ন্ত্রক মানুষের দল। যদিও শেষ পর্যন্ত শীর্ষেন্দুর গল্পের ধারা মেনে খারাপ মানুষেরা শাস্তি পায়, ভালো মানুষদের কোন ক্ষতি হয় না। আর গল্পের সময়চারী পথিক আশা রেখে যায় আগামী দিনের এমন এক পৃথিবীর যেদিন ভবিষ্যত বিজ্ঞান মানুষকে শুধু বাইরের অগ্রগতির পথে এগিয়ে দেবে না। একই সঙ্গে তার মনের পৃথিবীও অনেকখানি বদলে যাবে। আজকের হিংসা লোভ স্বার্থপরতা ভুলে মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে।
শীর্ষেন্দুর গল্প তার চেনা পথে চারণ করে। তবু বারবার তার গল্পের কাছে আমাদের এসে বসতে হয়, কেননা এই ছেলেমানুষের আশ্চর্য জগতের মধ্যে তিনি ভালো মানুষ মজার মানুষ এমনকি খারাপ মানুষকেও মিলিয়ে এমন এক পৃথিবীর গল্প বলেন যে পৃথিবীর অনেকটাই চেনা; আবার যে পৃথিবীতে আগামী দিনের বদলে যাওয়া মানুষের বিশ্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেই আনন্দময় বিশ্বের প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত মনকে ভারী প্রসন্ন করে তোলে।
রিভিউটি লিখেছেনঃ Soma
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।