review
বই - তেরোর ত্রাস
লেখিকা - দীপান্বিতা রায়
বইটিতে মোট তেরোটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলি হল
১. দরজার ওপাশে - শমিত গৌরীপুর গ্রামের শিবনাথ বসু উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলার মাস্টারমশাই হয়ে এসেছে প্রায় ছয় মাস হতে চলল। শমিত এদিকে ভালোমানুষ, গোবেচারা প্রকৃতির তাই ছাত্ররা তাঁকে মানে না মোটেই। ক্লাসে তো তাকে ভয় করেই না এমনকি স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করতেও ছাড়ে না। এই অসুবিধা থেকে বাঁচতে শমিত একদিন শর্টকাট নেয় এবং এসে উপস্থিত হয় একটি দোতলা বাড়ির সামনে, তাঁর কেমন যেন মনে হয় বাড়িটা এত দিন তাঁর অপেক্ষাতেই ছিল। সত্যিই কী বাড়িটা কারোর অপেক্ষাই ছিল?
২. অভিশপ্ত লাঠি - বাড়িটাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তু থাবা গুটিয়ে বসে আছে। উত্তরবঙ্গের এই মফস্বল শহরে ডাক্তার হিসাবে যোগ দেওয়ার পর যাতায়াতের পথে অনেকবার দেখেছে বাড়িটাকে। বাড়ির মালিক শঙ্কর মিত্তির। কয়েকমাস পড়ে আবার মিত্তির বাড়িতে ঢুকলো দিগন্ত। দিগন্ত কে দেখে নটবর এসে তার হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দিল। শঙ্কর মিত্তিরের কোন সত্য বন্দি ছিল খামের ভেতর?
৩. বামাপদবাবুর ছবি - বামাপদবাবু মিতব্যায়ী মানুষ। বিয়ে থা করেন নি। আত্মীয় স্বজন পুষ্যি কেউ নেই। সরকারি অফিসে আপার ডিভিশন ক্লার্কের কাজ করেন। মাইনে পত্র যা তাতে একা মানুষের দিব্যি চলে যায়। বামাপদবাবুর একটি অদ্ভুত অভ্যাস আছে। প্রায় প্রতি রবিবার সকালে তিনি পর্ক স্ট্রিটের অকশান হাউস এ যান। তবে নিয়মিত না হলেও নিলামঘর থেকে বামাপদবাবু কিছু জিনিস কিনেছেন। একদিন হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ছবি। ব্রাউন রঙের ফ্রেমে বাঁধানো। ছবির গল্পটি তাকে খুব আকৃষ্ট করলো, গল্পটিকে আরো ভালো করে জানার জন্য তিনি ছবিটি কিনে নিলেন। তারপর তিনি জানতে পারলেন ছবিটির সত্য?
৪. আলফ্রেড ভোলেনি - বড়দিনের ছুটির সাথে শনি ও রবিবারের ছুটি মিলিয়ে চারদিনের একটা ছুটি কাটাবে ভেবে তপন ধর্মতলা থেকে হলদিয়ার রাতের শেষ বাসে উঠে পড়ে। কিন্ত ঘটনাচক্রে মাঝপথে বাসের ইঞ্জিন স্টার্ট না হওয়ায় মহিষাদলে নেমে পড়তে হয় সকলকে। মহিষাদলের কাছে গেঁওখালিতে তপনের দূর সম্পর্কের এক পিসির বাড়ি থাকায় তপন রাত টা সেখানে কাটাবে স্থির করে। কিন্ত পিসির বাড়ি যাওয়ার পথে কী অপেক্ষা করছে তপনের জন্য?
৫. বাদামি চোখ - চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, মামা যতীন গুপ্ত জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন মুটুকপুরে। মামা মামি নিঃসন্তান হওয়ায় সেই বাড়ি পান মহিম বাবু। মহিম বাবু খুব মেজাজি প্রকৃতির মানুষ। বাড়ি দেখে মহিমবাবুর চক্ষুস্থির হয়ে যায়। অনন্ত দশ-বারো কাঠা জমির মাঝখানে দোতলা বাড়ি। চারিপাশ আম-জাম-জামরুল থেকে শুরু করে হরেক রকমের গাছে ভর্তি। বাড়ির ঠিক গায়েই একটা মস্ত আমগাছ। তিনি মনে মনে হিসাব করে দেখলেন দুটো টাওয়ার করে অনন্ত বত্রিশটা ফ্ল্যাটের আবাসন তৈরী করা যাবে। হিসাব মতো তিনি কাজ শুরু করে দিলেন। প্রথমেই মস্ত আমগাছটিকে কাটার প্রস্তুতি নিলেন। শেষ পর্যন্ত কী তিনি গাছটিকে কাটতে সক্ষম হয়েছিলেন?
৬. মধ্যরাতের ছায়ামূর্তি -কলকাতার কলেজে পড়ায় সুধন্য সরকার। থাকে জিওলগাছায়। সাধন পরেশ ও পল্টুর সাথে সন্ধ্যার মুড়ি তেলেভাজার সাথে ভূতের গল্প শোনাতে বসে সুধন্য। সুধন্যর বয়স তখন সাত আট। বাড়ি ছিল শেতলপাটা গ্রামে। বাবা ও কাকা দুজনেই শহরে চাকরি করতেন তাই চাষবাস এবং ঘরের কাজকর্ম সবকিছুর দায়িত্ব ছিল ঠাকুমার ওপর। ঠাকুমাকে সকলে খুব ভয় পেত। সুধন্যর কিকিমা কমবয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন তিনি একটু বেশিই ভয় পেতেন শাশুড়িকে। বাড়িতে হঠাৎই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগলো। খাঁচা থেকে হাঁস উধাও হল, বাড়িতে রক্তের ছাপ দেখা গেল। সবাই ধরে নিল বাড়িতে কোনো অশরীরীর আগমন ঘটেছে। সত্যিই কী ঘটেছিল কোনো অশরীরীর আগমন?
৭. ডোডোর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় - ডোডো ওরফে অর্ক সেনগুপ্ত একজন মাউন্টেনিয়ার। পাহাড়ে চড়তে সে ভালোবাসে। তার পাহাড়ে চড়া নিয়ে তার মা খুঁতখুঁতে জেনেও কেন জানি না সে বোঁচাদার এভারেস্ট অভিযানের দলের একজন হতে রাজি হয়ে যায়। কিন্ত মা তার এই অভিযানের ঘোর আপত্তি করলেন। রাগ দেখাবে ভেবে নিজের ঘরে এসে দরাম করে ঘরের দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে ঝপাস করে শুয়ে পড়ে সে। অমনি তার কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে "আহা অত রাগ করছিস কেন? দেখবি সব ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।" এটা কী শুধুই ডোডোর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়?
৮. ফ্রেমের বাইরে - একই চ্যানেলে কাজ করার সূত্রে সঞ্জীব আর প্রিয়মের ভালো বন্ধুত্ব হয়েযায়। পৌষ-সংক্রান্তিতে প্রিয়মদের বাড়িতে ধুমধাম করে কালীপুজো হয়। সব আত্মীয়স্বজন এক হয় বাড়িতে। ছবি তোলার প্রতি সঞ্জীবের নেশা আছে তাই প্রিয়ম যখন তাকে তাদের পারিবারিক পুজোতে তার সাথে যেতে বললে সে আর না করেনা। কিন্ত গ্রামের বাড়ির পুজো দেখতে গিয়ে কোন সত্যের সম্মুখীন হয় সঞ্জীব?
৯. হেনরি হাউস - স্ত্রী রূপা এবং মেয়ে রিমির সাথে গরমের ছুটি কাটাতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে অনিমেষ। চারদিন দার্জিলিং দুদিন কার্শিয়াং দুদিন কালিম্পং। দার্জিলিং কার্শিয়াং- এ লজে ঘর মিলেছে কিন্ত কালিম্পং-এ পছন্দের ক্যামেলিয়া লজের ঘর না পাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায় অনিমেষের। শেষে ক্যামেলিয়া আগে যে বাংলোটাই সেটা এখনও আছে। শেষমেশ অনিমেষ সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার পথে মনে এইটু খুঁতখুঁতানি ছিল কিন্ত হেনরি হাউসে পৌচ্ছে তাদের তিনজনের খুব পছন্দ হয়ে যায় জায়গাটি। কিন্তু মনোরম দর্শনীয় হেনরি হাউসের অতীতের গল্পটি জানতে পারবেন অনিমেষ?
১০. অশরীরীর ইঙ্গিত - লন্ডন থেকেই গেস্ট হাউসটা বুক করে ছিল অরিন্দম। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা হওয়ায় অরিন্দম আর প্রিয়া কলকাতায় এসেছে। প্রায় এক মাসের জন্য থাকতে হতে পারে তাই ইন্টারনেট ঘেটে অনেক দেখে তারপর তাদের দুজনের পছন্দ হয়েছে গেস্ট হাউসটি। গেস্ট হাউসের মালকিন শিলা মিত্রর ব্যবহার ও তাদের ভালোলাগে। কিন্ত এক দুদিনের মধ্যেই কেমন এক অস্বস্তি হয় প্রিয়ার। তার মনে হয় যেন তাদের দুজন ছাড়াও আরেকজনের উপস্থিতি অনুভব করছে সে। কী হবে শেষ পর্যন্ত?
১১. সেই লোকটা - অনেকদিন ধরে প্ল্যান করা হলেও কিছুতেই তা কাজে লাগানো যাচ্ছিলো না। অবশেষে তিন বন্ধু মৈনাক, প্রতীক, শান্তনু এক সাথে ছুটি পাওয়াই তিন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়ে, গন্তব্য গাড়োয়াল হিমালয়। প্রথমে নৈনিতাল। সেখান থেকে কৌশানি, তারপর বিনসর চকোরি, শেষে পিথোরাগড়। সেই অনুযায়ী বেরিয়ে পড়া কিন্তু ট্রেনের কামরায় এবং হোটেলে শান্তনু মনে হতে থাকে কে যেন তার পিছু নিয়েছে। শান্তনুর এমন মনোভাবের কারণ কী?
১২. তেরাখোলে এক রাত - দীপক আর রণিত ছোটবেলার বন্ধু। অনেক দিন পর দুজনেই একসাথে কাজে অবসর পেয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য গোয়া। প্রথমদিন তারা এসে ওঠে মান্ডবী নদীর ধারে গোয়ার রাজধানী প্যানজিম বা পানাজির একটি হোটেলে, পরে সেই হোটেলের মালিক তাদের সন্ধান দেন কুলু নদীর মোহনায় তেরাখোল দুর্গ। সেখানে তাদের আলাপ হয় এক বৃদ্ধের সাথে। কোন গল্প শুনিয়ে ছিলেন বৃদ্ধ তাদের?
১৩. তেরোটার ঘন্টা - নয়নপুরের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে ছিল জমিদার রামেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মানে দেবলের ঠাকুরদার ঠাকুরদা আমলের এই বাড়িটি। দেবলের মনে হয় বয়সের ভাজে একটা মস্ত জন্তুর মতো অতীতের গন্ধ গায়ে মেখে মাটিতে মুখ গুঁজে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে বাড়িটি। বাড়িটি বিক্রির জন্য দেবল আসে নয়নপুরে কিন্ত বাড়িটি অনেক দিন ধরে দেখাশোনা করেন নগেনদা দেবল কে দেখে চমকে উঠলেন কেন? তার ভয়ের কারণ কী?
নিজস্ব অনুভূতি - গল্পগুলোর মধ্যে যে গল্পগুলো বেশি ভালো লেগেছে বাদামি চোখ, মধ্যরাতের ছায়ামূর্তি,ফ্রেমের বাইরে,হেনরি হাউস, অশরীরীর ইঙ্গিত,তেরোটার ঘন্টা। গল্পগুলি পড়ে ভয়ের রেস না পেলেও পড়তে খারাপ লাগেনি। ঝরঝরে লেখনীর ফলে একটানা পড়ে ফেলতেও অসুবিধা হয়নি।