গল্পের নাম - প্রাণনাথ হৈও তুমি
লেখক - প্রীতম বসু
আহা আহা! কী অপূর্ব লেখা পড়লাম! প্রীতম বাবুর লেখা এই প্রথম পড়লাম আর মুগ্ধ না না আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! কী দারুণ লেখা! অনেক গবেষণার ফল যে এই লেখাটি তা আর বলতে হয় না!
(প্রথমেই ক্ষমা চাইছি আমি কীর্তন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ! তাই সনাতন কীর্তনের অস্তিত্ব আছে কি না গুগলবাবার পা ধরেও বুঝিনি! তাই আমি এটিকে কল্পনাশ্রয়ী কীর্তনগান হিসেবে ধরছি। যদি কেউ এই সম্পর্কে জানেন তাহলে দয়া করে একটু বুঝিয়ে দেবেন। আমি জানতে ভীষণ আগ্রহী।)
ডঃ নীতিশ নাগ ওরফে নাইট্রোজেন স্যারের ক্লাসে করতালতলীতে প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার সনাতন কীর্তন গেয়ে নীলমাধবের মূর্তিতে লীন হয়ে যাওয়ার গল্পটি শোনার পরেই পদাবলী তার ঠাকুমার শেখানো গান, ডায়েরীতে লেখা কিছু কথা আর করতালতলী নামক জায়গাটি সম্পর্কে জানতে ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠে! স্যারের উৎসাহে সে করতালতলীতে প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার মূল বায়েন(অর্থাৎ মূল বাজিয়ে) ছিদাম বায়েনের কাছে যাতায়াত শুরু করে। এদিকে ছিদাম বায়েনকে আবার তৎকালীন জমিদার নীলমাধবের মন্দির আর সংলগ্ন অঞ্চলের অছি করে দিয়ে যান, তাই ছিদাম বায়েন আর তার ছেলে গোবিন্দ অধিকারীর সাথে জমি বিক্রি নিয়ে বিরোধ বেঁধেছে বর্তমান জমিদারের ভাইয়ের। তারা এসব বেচে রিসোর্ট খুলতে চায়, কিন্তু ছিদামরা বেচতে রাজি নয়। একদিকে নাইট্রোজেনের (কল্পনার?) ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া কীর্তনকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা আর একদিকে ছিদাম আর গোবিন্দের চৈতন্য পুখুরী, ধূলট বাঁচানোর লড়াই, পদাবলী সবদিকে জড়িয়ে পড়ে। এতটাই জড়িয়ে পড়ে যে প্রাণহানির মতন আশংকাও তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না।
কেন? প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার কিইবা গল্প? নীলমাধবের মূর্তিতে লীন হওয়া কি সম্ভব? পদাবলীর ঠাকুমা কে ছিলেন? নাইট্রোজেনেরই বা এত উৎসাহ কেন? পদাবলী কি পারবে সব ঠিক করতে?
আর একটুও বলবো না, শুধু বলবো যে পড়ে ফেলুন এই গল্পটি। বহুদিন মনে একটা রেশ থেকে যাবে। মন্দিরা, ছোটরাজাবাবু মৃদঙ্গম, প্রাণনাথ আর প্রতিমাদেবীর জন্যে মনকেমন করবে।
রেটিং দিয়ে এই গল্পটিকে ছোট করলাম না।
গল্পের মহিমায় বানান ভুল একদম নজর পড়েনি!
রিভিউটি লিখেছেনঃ
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।
বইয়ের নাম :- প্রাণনাথ হৈও তুমি
পার্সোনাল রেটিং :- ৮.৫/১০
অদ্ভুত লেখনী প্রীতম বাবুর , মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে থ্রিলার পড়ছি নাকি কোনও প্রেমের উপন্যাস পড়ছি । ইতিহাস - পদাবলী সাহিত্য - প্রেম - থ্রিলার সবেতেই এমন সুনিপুণ ভাবে বিচরণ করেছেন যে লেখকের গুণমুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।
পদাবলী , এক কলেজ ছাত্র কিভাবে জড়িয়ে পড়ে করতালতলীর সুবর্ন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের সাথে এবং প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার নীলমাধবের মূর্তির মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া গল্পের মূল উপজীব্য। তবে যত গভীরে যাওয়া যায়, প্রবেশ হয় মন্দিরা চরিত্রটির , তার সাথে প্রাননাথের প্রেমের সাক্ষী থাকে পাঠক। উপন্যাস শেষ হয়ে গেলেও মন্দিরা যেন মনের মধ্যে থেকে যায়। কোনও কোনও সময়ে মনে হয় প্রাণনাথ আর মন্দিরার প্রেমই হলো গল্পের প্রধান বিষয়। উপন্যাসটি না পড়লে জানাই যায়না আমাদের , বাঙালিদের গৌরবময় পদাবলী সাহিত্যের কথা। এক কথায় , থ্রিলার পড়তে পড়তে বাংলার পদাবলী সাহিত্যের অনেক কথাই জানতে পারা যায় , কুর্নিশ জানাই লেখকের এই গবেষণাকে। তবে কোথাও কোথাও গল্পের গতি একটু শ্লথ হয়েছে , অতিরিক্ত পদাবলীর সংযোজনে। একচেটিয়া অর্থোডক্স টাইপের থ্রিলার না হলেও সাসপেন্স নভেল বলাই যায়। গল্পের মূল প্লটের থেকেও তার সাবপ্লট অনেক বেশি উপভোগ্য। পড়ার পর একটা রেশ লেগে থাকে মনের মধ্যে।
“ মন্দিরা সন্তর্পনে দরজা খুলল। প্রাণনাথ খরুটি ঘরের দালান থেকে উঠনে নামল। তারপর একবারও পিছনে না তাকিয়ে খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে অন্ধকারে বনতুলসির ঝোপে হারিয়ে গেল। মন্দিরার বুকের ভিতরে সাশ্রু নয়নে চণ্ডীদাসের রাধা বিড়বিড় করে বলল - জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি ... "
রিভিউটি লিখেছেনঃ Jeet
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।
বইয়ের নাম:- প্রাণনাথ হৈও তুমি
লেখক- প্রীতম বসু
একটু আগেই শেষ করলাম উপন্যাসটা। শেষের অংশটুকু পড়তে পড়তে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।
অসাধারণ, অনবদ্য বললেও বোধ হয় কম বলা হয়। সত্যিই ভাষাহীন হয়ে গেছি। কবি প্রীতম বসু এই উপন্যাসের মধ্যে যেমন বাঙালির হারিয়ে যাওয়া কীর্তন, সনাতন কীর্তন, প্রাচীন কীর্তনের সুর- তাল - লয় এগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঠিক তেমনই অপরদিকে ফুটিয়ে তুলেছে তৎকালীন সময়ের অগ্নিগর্ভ সমাজকে।
আবার ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দর প্রেমের কাহিনী। এছাড়াও পাঠক এই উপন্যাস পড়ে আমাদের বাঙালিদের এক গৌরবময় অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারবে যা আমরা হারাতে বসেছি।
সত্যিই বর্তমানে বিদেশি গান, হিন্দি গান এসব আমাদের আড্ডায় - গল্পে বহুল আলোচিত হলেও বাঙালির নিজের সম্পদ , কীর্তনের আলোচনা প্রায় শোনাই যায়না। এটা আমাদের চরম ব্যর্থতার প্রতীক।
এই উপন্যাসের রেটিং দেওয়ার সাহস বা ধৃষ্টতা আমি দেখাবো না। এই উপন্যাস পড়েই স্বজাতির অনেক হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় ইতিহাস জানতে পারলাম আজ। ❤️
রিভিউটি লিখেছেনঃ Elora
গ্রন্থ – প্রাণনাথ হৈও তুমি
লেখক – প্রীতম বসু
প্রকাশক – প্রীতম বসু
মুদ্রিত মূল্য- ৪০০
তানসেনের নাম তো নিশ্চই শুনেছেন, কিন্তু নরোত্তম ঠাকুরের নাম শুনেছেন কি?, না তো, আমিও শুনিনি, এনাদের দুজনেরই সঙ্গীতের তালিম হয়েছিলো হরিদাস স্বামীর কাছে। তানসেন যেমন ধ্রপদ সঙ্গীতকে এক অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনই শ্রী নরোত্তম ঠাকুর বাংলার কীর্তনে ধ্রপদ প্রভাবিত এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন, যার নাম গড়ানহাটি। কি গড়ানহাটি নামটা প্রথম শুনছেন তো, আমিও তাই, তাহলে শুনুন কীর্তনেরও নাকি ঘরানা হয়, তাও একটি দুটি নয়, পাঁচ পাঁচটি ঘরানা আছে কীর্তনের, সেগুলি হলো – গড়াণহাটি, মনোহরসাই, রেনেটি, মন্দারণী আর ঝাড়খণ্ডী। তারপর কীর্তনের মধ্য নাকি তাল থাকে সেগুলি হলো - আড়, দোজ, যতি, শশীশেখর, গঞ্জন, পঞ্চম, রূপক, সম – আটটি তাল। এগুলিও শোনেননি , আচ্ছা, অসুবিধা নেই, গীতগোবিন্দের নাম তো শুনেইছেন নিশ্চই, ওই যে জয়দেবের লেখা হ্যাঁ হ্যাঁ এবারে ঠিক ধরেছেন, আচ্ছা গীতগোবিন্দের দ্বাদশ- অধ্যায়ের নাম কি বলুন তো, জানেন না তো, জানতাম পারবেন না, শুনুন - সামোদ, দামোদর, অক্লেশ, কেশব, মুগ্ধ মধুসূদন, স্নিগ্ধ মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট বৈকুণ্ঠ, নাগর নারায়ণ, বিলক্ষ লক্ষীপতি, মুগ্ধ মুকুন্দ....- গীতগোবিন্দের দ্বাদশ অধ্যায়।
ওপরে যে সকল নাম বললাম সেগুলো আমিও কিচ্ছু জানতাম না, কিন্তু বিশ্বাস করুন উপন্যাসটা পড়ার পর না মনে হচ্ছিল ছিঃ, এগুলো তো জানা উচিত ছিলো একজন বাঙালি হয়ে, যাই হোক আমি এই উপন্যাস পড়ে তো অভিভূত হয়ে আছি আপনিও পড়ুন আমি চাই। এর বেশি স্পষ্ট করে আমি লিখতে পারছি না আর।
বিষয়বস্তু লিখব নাকি লেখকের স্তুতি করব বুঝতে পারছিনা। এমন একটি বিষয় নিয়ে গ্রন্থ যেটা তে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। অথচ এখন বইটা পড়ার পর বলতে পারি না আমি কিছুটা হলেও জেনেছি, কিছুটা হলেও শিখেছি। যারা বাংলার ঐতিহ্যকে ভালোবাসেন তারা একবার বইটা হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। হতাশ যে হবেন না তার দায়িত্ব আমি নিলাম। যাক এবার বক্তব্যে আশি।
এই গ্রন্থ পড়ার পূর্বে প্রীতম বাবুর চৌথুপীর চর্যাপদ, পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল পড়ে ছিলাম, তখন থেকেই প্রীতম বাবুর লেখার ভক্ত। প্রতিটা বইই আমি পিডিএফে পড়েছি, তবে হাতের কাছে পেলে অবশ্যই কিনে রাখব। এটিও আমি পিডিএফে পড়া শুরু করি। রবিবার শুরু করেছিলাম মঙ্গলবারে শেষ করছি, হার্ডলি চার সিটিং-এ ৪১০ পাতার পিডিএফ পড়ে শেষ করার একটা আলাদা আনন্দ কাজ করছে মনের ভিতররে। এতটাই টানটান প্লট ছিলো এই উপন্যাসে যা বাধ্য করেছে আমাকে দ্রুত শেষ করতে।
৪১০ পাতার এই নাতি-বিস্তর উপন্যাসের বিষয়বস্তু বাংলার কীর্তন। হ্যাঁ বাংলার বললাম কারণ এ সম্পদ বাংলার ও বাঙালির নিজস্ব। যারা মোটামুটি প্রীতম বাবুর লেখার সাথে পরিচিত তারা জানেন যে প্রীতম বাবু বাঙলার ঐতিহ্য নিয়ে কতটা গর্বিত, ওনার সমস্ত লেখাতেই বাঙালির ইতিহাস, বাঙালার ধর্ম, বাংলার জ্ঞান-গরিমাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসও তার ব্যাতিক্রম নয়। প্রাণনাথ হৈও তুমি উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে বাংলার কীর্তনের স্বর্ণযুগের সাথে পরিচয় করালেন এবারে, এবং এই কর্মে তিনি সিদ্ধকাম।
পূর্ব উপন্যাসের ন্যায় এখানেও দুটি ভিন্নকালের ঘটনা সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। একটির সময়কাল স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ বাংলা (১৯১০-১৯৩০) আরেক একটি ঘটনা ১৯৯৬ এর কোলকাতা। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে বাংলার বুক থেকে তার নিজস্ব সম্পদ্ নিজস্ব আবেগ কীর্তন হারিয়ে যেতে বসেছে, এবং তাকে বাঁচানোর প্রাণপন তাগিদ কিছু মানুষের মধ্যে। এক অসম লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে কিভাবে একটি ২১-২২ বছরেরে ছেলে কীর্তনকে বাঁচাতে চাইছে। সেই কীর্তনের গল্পের মোড়কে এসেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিপ্লবীর গল্প। সেখানে আছে প্রেম, বিরহ, সুখ দুঃখ, প্রতিশ্রুতি, অভিমান, আত্মত্যাগ। প্রাণনাথ ও মন্দিরার প্রেম এই উপন্যাসের যেন সর্বশ্রেষ্ঠ উপভোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। যখনই তাদের কথা বলেছেন লেখক তখন যেন আরও জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে তার লেখনী। তবে সমস্ত উপন্যাস জুড়ে শুধুই বাংলার কীর্তনের গল্প।
যখন লেখক বলছিলেন যে বর্তমানে কীর্তনের যে ধ্বংসপ্রায়তা তার জন্যা আমরা নিজেরাই কি দায়ী নয়, তখন সত্যি বলছি লজ্জিত হয়েছি। আমি অন্তত কীর্তনের বিন্দু মাত্র ভক্ত ছিলাম না, কিন্তু এই উপন্যাস পড়ে একটু হলেও কীর্তন সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছে। কীর্তনের মধ্যেও এত তত্ত্ব থাকতে পারে তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। এত নিগুঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে ভাবলেও অবাক লাগছে। বাংলার একান্ত যে সম্পদ কীর্তন তার সম্পর্কে এক নতুন দিক্ খুলে দিতে পারে এই গ্রন্থ।
ওনার লেখার একটা বিরাট বৈশিষ্ঠ হলো ঐতিহাসিক তথ্য, উনি পাতার পর পাতা জুড়ে ইতিহাস বলে চলেন গল্পের ছলে। যেটা অনেকের হয়তো পছন্দ নয়, কিন্ত আমি আবার এই কারণেই ওনার উপন্যাসের ভক্ত। তবে কিছু জায়গায় শুধুমাত্র ইতিহাস বলতে হবে বলেই যেন জোর করে বলানো হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। সকল চরিত্ররা যেন জীবন্ত মানুষের মতো তিনদিন সাথে ছিলো আমার।
রিভিউটি লিখেছেনঃ রাহুল