কাহিনী: বাঁহর
লেখক: ত্রিজিৎ কর
উৎস: বিভা ভূত-ভুতুম
প্রথমেই বলি, বিগত কয়েক বছরে বিভা ভূত-ভুতুম উৎসব সংখ্যায় ত্রিজিৎ করের লেখা উপন্যাসগুলি পড়ে বেশ ভালোই লেগেছে। তবে, আমার বিচারে সেরা ছিলো ১৪২৮ বঙ্গাব্দের (সম্ভবতঃ) কাইতি উপন্যাসটি। গতবারেরটা তুলনামূলকভাবে সেই উচ্চতায় উঠতে পারেনি বলে এবারের "বাঁহর" উপন্যাসটির প্রতি প্রথমেই আগ্রহ জন্মালো এবং বলা বাহুল্য সেটি দিয়েই বিভা ভূত-ভুতুম উৎসব সংখ্যা ১৪৩০ পড়া শুরু করলাম।
"বাঁহর" ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস। শুধু তাই নয়, বর্তমান কালের কোনোও অস্তিত্ব নেই এখানে। কাহিনীতে শুধুই সপ্তদশ শতক। সেই সময়ে দুর্দ্ধর্ষ আরাকান দস্যুদের (মগ) দ্বারা আক্রান্ত ও অপহৃত হয়ে শ'য়ে শ'য়ে বাঙালী নরনারী ক্রীতদাসরূপে বিক্রীত হয়ে যাচ্ছে পিপলী দ্বীপ হয়ে বিদেশের হাটেবাজারে। সাধারণ মানুষের কান্না হাহাকারে বঙ্গভূমি শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে তখন। বাঙালীর আদি গৌরব অস্তমিত। সেই সময়ে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন এক বারো ভুঁইয়া যুবরাজ বাপ্পাদিত্য, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনিও বন্দী হলেন নিষ্ঠুর মগদের গুপ্ত কারাগারে। সেখানে তিনদিন অনাহারে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করবার পর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই বাপ্পাদিত্য মুক্তি পেলেন অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী এক রহস্যময় বৃদ্ধ চন্দ্র গুনীনের সহায়তায়। নানান বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে, বাপ্পাসহ আরোও কয়েকজন বন্দী যুবক যুবতীকে নিয়ে চন্দ্র গুনীন গিয়ে উঠলেন সুন্দরবনের এক প্রান্তে "বাঁহর" দ্বীপে, সবার দৃষ্টিতে যে দ্বীপ অভিশপ্ত। সাধারণ মানুষ তো দূর, নিষ্ঠুর মগেরা পর্যন্ত সেখানে পা দেয় না।
কি সেই অভিশাপ? কেন দ্বীপে ফুটে থাকা অজস্র লালফুল ছিঁড়লেই তারা প্রবল আর্তনাদ করে ওঠে? "বাঁহরবিবি"-ই বা কে? বাপ্পা ও তার সঙ্গীরা কি বাঁহরদ্বীপে কোনোও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে? শেষপর্যন্ত কি হবে?
প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় লেখক ত্রিজিৎ করের "বাঁহর" উপন্যাসে।
এই কাহিনীতে বিভিন্ন ভয়াল ভয়ঙ্কর মুহূর্তের বর্ণনার সঙ্গেই আছে পবিত্র প্রেমের স্পর্শ। সুপুরুষ যুবরাজ বাপ্পা প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে কারাগার থেকে পালিয়ে আসা এক অতি সাধারণ অষ্টাদশী কন্যা রোহিনীর―যার আবার অনেক ভেষজ উদ্ভিদের কার্যকারিতা সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। বাপ্পা-রোহিনীর প্রেম কোথাও কাহিনীর গতিরোধ করেনি―বরং স্বচ্ছতা গতিতে তা বহমান হতে সাহায্য করেছে। সেই সঙ্গেই আছে অন্তঃস্বত্ত্বা বধূ কুমুদিনীর করুণ আখ্যান এবং বারাঙ্গণা বকুলের, বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার বিবরণ, চার পত্নীর পতি কুলীন ব্রাহ্মণ ভদ্রেশ্বরের সর্বক্ষেত্রে অসারতা প্রদর্শন ও হিন্দু-মুসলমানের একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুনিধনের মতো স্মরণীয় মুহূর্ত।
কাহিনীর শেষদিকে প্রচুর টুইস্ট আছে। যা আমার যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে। তবে বলবো, কাহিনীর সময়কাল সপ্তদশ শতাব্দী না হয়ে বর্তমান কাল হলেও বিশেষ কিছু রদবদল করতে হতো না। কাহিনীর শেষে অনেক কল্পবিজ্ঞানসুলভ মুহূর্তের অবতারণা করা হয়েছে, যা বর্তমান কালের সঙ্গে অধিক মানানসই হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী চরিত্রগুলিকে তৎকালীন গুণসম্পন্না মনে না হয়ে বর্তমানকাল সুলভ গুণের অধিকারী বলে মনে হয়েছে আমার। এটা অবশ্য আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত।
শুধুমাত্র একটি বিষয়ই আমার আপত্তিকর লেগেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে (১৬০০ থেকে ১৬৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) বকুলকে কলকাতার বাইজী পাড়ার বদলে হুগলী বা সপ্তগ্রামের বাইজী বলে পরিচয় দিলে হয়তঃ অধিক যুক্তিযুক্ত হতো।
পর্যালোচকের রেটিং: ৬/১০
রিভিউটি লিখেছেনঃ Srijit Mitra
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।