বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ
জওহরলাল নেহরু
জেলে বসে সময় কাটাতে বাবা চিঠি লিখছেন মেয়েকে। আগেও লিখেছেন। তখন মেয়ে ছিল ছোট। সেই সময় লিখেছিলেন বিশ্ব সৃষ্টি আর মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস। আর এবারে, তিনটি কারাগার (নাইনি, বেরিলি, দেরাদুন) থেকে তিন বছর ধরে ১৯৭টি দীর্ঘ পত্র লেখেন। এবারের বিষয় পৃথিবীর ইতিহাস।
সেই চিঠিগুলো একত্রে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন মেয়েটির পিসি। ইংরেজিতে লেখা এই চিঠির সংকলনের নাম দেন GLIMPSES OF WORLD HISTORY. প্রথমে প্রকাশিত হয় এলাহাবাদ থেকে। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয় , জে এফ হোরাবিনের আঁকা নিপুণ ও তাৎপর্যপূর্ণ পঞ্চাশটি মানচিত্র। পরে বাংলায় অনুবাদ হয় ' বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ' নামে।
মেয়ে, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। বাবা, জওহরলাল নেহরু। আর পিসি, বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত। চিঠি লেখার সময়কাল অক্টোবর ১৯৩০ থেকে আগস্ট ১৯৩৩ সাল।
প্রথম চিঠি লিখছেন মেয়ের তেরো বছরের জন্মদিনে। সেন্ট্রাল জেল, নাইনি, ২৬ অক্টোবর ১৯৩০ তারিখে। 'ছেলেবেলা থেকেই তোমার জন্মদিনে তুমি উপহার আর শুভেচ্ছা পেয়ে এসেছ। নাইনির জেল থেকে আমি কেবল তোমায় আন্তরিক শুভেচ্ছাই পাঠাতে পারি। উপহার আর কী পাঠাব তোমায়? কায়েদখানার ভিতর থেকে তোমায় যে উপহার আমি পাঠাব তাকে বন্দী করে এমন সাধ্যি এই চারিদিকের উঁচু প্রাচীরের নেই, কারণ সে উপহার হল আমার মনের জিনিস!'
কেন এইসব ইতিহাস কথা লিখছেন তার কারণ হিসাবে যা বলছেন,' স্কুল-কলেজে আমরা যে ইতিহাস পড়ি তা যৎসামান্য। অন্যদের কথা ঠিক জানি না, তবে আমার নিজের সম্বন্ধে বলতে পারি যে, স্কুলে আমি খুব অল্পই শিখেছি।... অন্যান্য দেশের ইতিহাস খুবই আবছা-রকম শিখেছিলাম। সত্যকার ইতিহাস আমি পড়তে শুরু করি কলেজ থেকে বেরোবার পর।'
আবার জেল থেকে লেখার যুক্তি দিচ্ছেন 'কারা-জীবনের কতগুলি সুবিধা আছে; সেখানে কাজের অবসর পাওয়া যায়, মনকে কিছুটা সমাহিত করিয়া আনা যায়।'
শেষ চিঠিতে লিখছেন , ' আমি তোমাকে দিলাম বিশ্ব-ইতিহাসের একটা খসড়ামাত্র; ইতিহাস এ নয়― যা শুধু আমাদের দীর্ঘ অতীত কাহিনীর দুটো-একটা আভাস। ইতিহাস পড়তে যদি তোমার ভালো লাগে, ইতিহাসের কাহিনীর মধ্যে যে মোহ আছে তার আকর্ষণ যদি অনুভব কর, তবে তখন নিজে থেকেই বহু বই তুমি খুঁজে বার করতে পারবে...'
চিঠিগুলি খুবই সরস ভাবে লেখা। বাবা মেয়ের মিষ্টি-মধুর কথোপকথন যেমন হয়। কোথাও আবার, আমার বাবা সব ঠিক জানে, এমন বিশ্বাস রাখতেও নিষেধ করেছেন। লিখছেন, ' এই চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি তাকেই কোনো ব্যাপার সম্বদ্ধে চরম এবং অভ্রান্ত তত্ত্ব বলে মনে কোরো না। রাজনীতিবিদের স্বভাব, সমস্ত ব্যাপার সম্বদ্ধেই সে একটু কিছু বলতে চায়, সব সময়েই এমন ভাব দেখায় যেন আসলে যেটুকু সে জানে তার চেয়ে আরো কত বেশিই তার জানা আছে।'
বইটার আর একটা দারুণ দিক, বিশ্ব সাহিত্য থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি, বিভিন্ন কবি ও লেখকের। একদম শেষে লিখছেন, " আর একটি মাত্র কবিতা উদ্ধৃত করে আমি চিঠি শেষ করব। একটি কবিতা বা প্রার্থনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত:
'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীরআপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরীবসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতেউচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতেদেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়–যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশিবিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথাতুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা–নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।"'
------------
এই ১০১১ পৃষ্ঠার বৃহৎ বইটা আমার অন্যতম প্রিয় বই।
রিভিউটি লিখেছেনঃ
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।