বই : দূরবীন
লেখক : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
"উপরে অখন্ড আকাশ, জলে তাহারই শতধা ভঙ্গুর ছায়া। ঠিক এই জীবনের মতো। একটি শাশ্বত, একটি মায়া। তবে মায়ার ভিওরেও ওই শাশ্বতেরই খন্ড খন্ড ছায়া আছে। যে ছায়া লইয়া থাকে সে তাই থাক। যে আরো কিছু চায়, সে উপরের দিকে চাহিবেই।"
তিন প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা নানাখাতের জীবনদর্শনের নাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "দূরবীন"। প্রথম প্রজন্মে জমিদার হেমকান্ত ও তার অতি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গোপন প্রেমিকা রঙ্গময়ী, দ্বিতীয় প্রজন্মে কৃষ্ণকান্ত, তৃতীয় ও শেষ প্রজন্মে বর্ণিত ধ্রুব ও তার স্ত্রী রেমির জীবন ঘিরে আবর্তিত হয় চলে উপন্যাসটি। রঙ্গময়ী ও কৃষ্ণকান্ত - উপন্যাসের তিন প্রজন্মের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সেতুর ভূমিকায় অবতীর্ণ।রঙ্গময়ী আর রেমি- দুই প্রজন্মের দুই সহনশীলতা, নারীত্ব আর ভালবাসার প্রতিমূর্তি। বিশেষত, মনু (রঙ্গময়ী)-র ব্যক্তিত্ব এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার অসাধারণ দক্ষতা মনে রয়ে যাবার মতন। শচীনের চরিত্রটি স্বল্প পরিসরে মুগ্ধ করে। জীবনের শেষে উপস্থিত হয়েও মানুষ কষে চলে তার পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। ছোটো ছোটো আঘাত, ছোটো ছোটো ভালো লাগা সব বেড়ে ওঠে মানুষের ভিতরে ছোট্ট চারাগাছের ন্যায়, যা পরবর্তীতে পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটায়।
গোটা উপন্যাসে সবচেয়ে যে অবাক করেছে প্রাথমিকভাবে সে ধ্রুব। মন্ত্রী বাবার "কবচ-কুন্ডল" নিয়ে জন্মানো, শৈশবে মাতৃহারা ধ্রুবর তার বাবা কৃষ্ণকান্তর প্রতি আজন্ম বিদ্রোহ কোথাও যেন তাকে নিজের কাছেই হারিয়ে দিচ্ছিল, কৃত্রিম উচ্ছৃঙ্খলতা কেড়ে নিচ্ছিল বাঁচার অভ্যাস- যার ফল অনেকটাই ভুগতে হয়েছে সরল রেমি-কে। ধ্রুব চরিত্রটিকে কখনোই ভালো মন্দ মিশিয়ে মনে হয় না যেন, যখন খারাপ তখন সে যেন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম, রূঢ়, আবেগহীন মানুষ; আবার যখন ভালো, তখন সে যেন দেবতা, আদর্শ পুরুষ, যথার্থ নায়ক। এই দু'ই চরম দশার মধ্যে কোনো মধ্যবর্তীতার যেন স্থান নেই। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাদু হেমকান্ত ও নাতি ধ্রুবর কিছু জীবন দর্শন যেন সমাপতিত হয়েছে। ধ্রুবর রেমির প্রতি ভালোবাসা কোনো বাঁধাধরা নিয়মে আবর্তিত হয়না, রেমির সঙ্গে এক অদ্ভুদ ওঠাপড়ার মতো সম্পর্ক ধ্রুবর, কখনো ভালবাসা, কখনো শারীরিকতা, কখনো আবার চরম উপেক্ষা। তা সত্ত্বেও ধ্রুবর প্রতি রেমির ভালোবাসা থাকে অবিচল। তাঁর ভালবাসা অনন্ত আঘাতেও জোনাকির মতো। ধ্রুব মদ খায়, ইতিউতি সম্পর্ক করেও কোন এক অদ্ভুত মায়ায় রেমিকে ছাড়তে পারে না।একদিকে রেমির সঙ্গে রহস্যময় সম্পর্ক, অন্যদিকে পিতা কৃষ্ণকান্তের মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে ও শেষ অবধি আত্মহনন.... এর মধ্যে বিক্ষত ধ্রুবর মানসিক উথালপাতাল দিয়েই শেষ হয় এই বৃহৎ উপন্যাসটি।
আর, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যার উপস্থিতি এবং প্রভাব সবচেয়ে বেশি,যিনি এই উপন্যাসের মধ্যমণির ভূমিকায় অবতীর্ণ, কখনো পিতার গর্বের, স্নেহের ধন, কখনো পুত্রের অজানা ঘৃণার পাত্র, যাকে এই উপন্যাসের শ্রেষ্ঠতম চরিত্র মনে হয়েছে, তিনি অবশ্যই শ্রী কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী।
বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, জীবনকে দেখার বেশ কিছু নতুন আঙ্গিক, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করলো এই দ্বিস্তরীয় উপন্যাস।
রিভিউটি লিখেছেনঃ সংগৃহীত
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।