হলদে পাখির পালক
লীলা মজুমদার
লীলা মজুমদার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নাম। মূলত শিশু সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বহুলাংশে পরিচিত। আমরা হয়তো অনেকেই জানি তাঁর সাথে বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর যোগ রয়েছে। লীলা মজুমদার নিজস্ব দক্ষতা ও রচনা শৈলীর গুনে এক অদ্ভুত কল্পনা জগতের সৃষ্টি করেন যেখানে শিশুর কল্পনা প্রবণ মন পায় এক অনাবিল স্বাধীনতা, পায় বিকশিত হওয়ার পরিসর। ছোটবেলায় লীলা মজুমদারের লেখা "সবভুতুড়ে" নামক একটি গল্প সংকলন পড়েছিলাম। আর পাঁচটা ভূতের গল্প থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ভিন্ন স্বাদের গল্প সংকলন। তাঁর সাবলীল ভাষা ও নিপুন বর্ণনার পরতে পরতে রয়েছে এক অদ্ভুত মায়ার আবেশ যা জাগরিত করে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি। এরকমই এক রচনা হল হলদে পাখির পালক। গল্পে রয়েছে বোগি, রুমু, ঝগড়ু, নাথু, বোগি ও রুমুর দাদু ও দিদিমা। বোগি ও রুমু দুই ভাই বোন। বোগি বয়সে বড়,সে প্রায়ই কাজের লোক ঝগড়ুর বলা গল্পগুলিকে গুল বা গাঁজাখুরি গল্প বলে চিহ্নিত করে। যদিও তার ঝগড়ুর গল্প শোনার সাধ কোন অংশে কম নয়। রুমু বোগির ছোট বোন, সে পশু পাখি, মানুষের কষ্টে কেঁদে ওঠে। সে তুলনায় একটু বেশি সরল তাই সে ঝগড়ুর গল্প সহজ মনে বিশ্বাস করে নেয়। ঝগড়ু ওদের বাড়িতে কাজ করে। বাচ্চা দুটো তাদের প্রিয় পোষ্য ভুলুর দুঃখে যখনি মনমরা হয়ে পড়েছে সে তাদের দুমকার আশ্চর্য সব গল্প বলে মন ভুলিয়েছে। এরকমই এক গল্প হলদে পাখির গল্প। সে পাখি কেউ চোখে দেখেনি, তার পা নেই, শুধু আকাশে উড়ে উড়ে বেড়ায় ,ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়লে কোনো কুকুর খেয়ে ফেললে সে পরের দিন মানুষ হয়ে যায়। এদিকে ভুলুকে ও পাওয়া যাচ্ছিল না, শেষে ফিরে এলো মুখের কোনে হলদে পালক নিয়ে। এই পাখির পালকের ঝাপটা যে খেয়েছে সে কোথাও তিষ্ঠতে পারে না। বোগি, রুমু ও ঝগড়ুর কথোপকথন ও দুমকার আশ্চর্য, আজগুবি গল্প বলার মাধ্যমে গল্পটি ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায়, ঠিক গল্পে বলা গুনমনি লতার মতো।এটি মূলত শিশুদের জন্য লেখা হলেও এতে রয়েছে দর্শন ও গভীর জীবনবোধ, যা সময়ে সময়ে ভাবিয়ে তোলে। দু একটার উল্লেখ না করলেই নয়; " ও গাছ হল গিয়ে মানুষের মনের গুনের মত, কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না", "সুখীরা পালায় না কে বলেছে, দিদি? সুখীরা পালায় ঐ সুখের কাছ থেকেই। দুঃখু পায় না বলে দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়।'', "বুঝলে বোগিদাদা, লখনিয়া তোমাদের মতো ছিলো। কষ্ট পাবার ভয়ে কাউকে ভালবাসতো না, কোন মানুষকে না, কোন জিনিসকে না...
মানুষ চলে যায়, ভুলে যায়, মরে যায় আর জিনিস ভেঙে যায়, চুরি যায়, হারিয়ে যায়। কী হবে ভালবেসে?", " সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয় বলা মুশকিল।" সর্বোপরি লেখিকা এত সুন্দরভাবে কল্পনা জগতের উপস্থাপন করেছেন, ঝগড়ুর বলা শীতের বনে পাতা খসার শব্দ, দুমকার কাঁচ তৈরির গল্প, পক্ষীরাজ এর গল্প আমাদেরকে সেই জগতে টেনে নিয়ে যায়। নিছক আজগুবি গল্প মানস পটে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষে ঝগড়ুর কথা দিয়ে শেষ করলাম..." দুনিয়াটাই তো আশ্চর্য জিনিসে ঠাসা; তোমার বইওয়ালারা সেসব কথা না লিখলে আর আমি কি করবো?"
রিভিউটি লিখেছেনঃ ry
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।