সোনাপদ্মা
দিনেশচন্দ্র রায়
উপন্যাস
দিনেশচন্দ্র রায়ের এই উপন্যাসে বিশশতকের তিন থেকে চার দশকের প্রাক-স্বাধীন পর্বের কয়েকটি বছরের ইতিহাস ধরা আছে। প্রেক্ষাপট অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গ, পাবনাসহ নিকটবর্তী গ্রাম সোনাপদ্মা। একটি সমৃদ্ধ হিন্দু- মুসলিম অধ্যুষিত বর্ধিষ্ণু গ্রাম। শান্তিপূর্ণ নিস্তরঙ্গ ছন্দে বয়ে চলা জীবনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশ দমননীতি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, মুসলিম লীগের উত্থানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আঁচ। ক্রমশ গ্রামীণ শান্তি ব্যাহত হয়। ব্যক্তিজীবন পরিবারজীবন থেকে সামাজিক জীবনেও তার প্রভাব পড়ে। লেখক দেখান কিভাবে এই অশান্তির পরিসরে বিচিত্র মানসিকতার মানুষ পরস্পরবিরোধী স্বার্থ নিয়ে সময়ের আধারে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে অসুস্থ সময়কে লেখক ধরেছেন এবং তারই মধ্যে সাধারণ জনজীবনের দিশেহারা অবস্থার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাস শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গনে তিনপুরুষের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার খবর দিয়ে।
অতঃপর সোনাপদ্মা গ্রামের অধিবাসী মানুষগুলিরও নতুন করে কয়েক বছরের মধ্যেই চলে যাওয়ার ডাক আসে। গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলি পাঁচ পুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে যায় --- পুরনো জমিদারেরা একে একে বিদায় নিতে থাকেন; এভাবেই নিরবধি কাল ধরে কখনো ভাঙে নদী, কখনো দ্বিখন্ডিত হয় দেশ, কখনো মানুষের মন। লেখক দেখান, এর কোন কিছুই আকস্মিক নয়; জাতির অন্তঃস্থলে এই ভাঙ্গনের জন্য অগোচরে প্রাক-প্রস্তুতি শুরু হয়; আত্মরতি সম্পন্ন দায়িত্বজ্ঞানহীন জাতির চেতনায় ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, সে অন্ধকারে বাসা বাঁধে অজস্র ঘুণপোকা, একদিন সেখান থেকে তার পারিপার্শ্বিক যাপন পরিচয় সংস্কৃতিতে ধস নামে। একটি বড় ভাঙ্গনের গল্পের অন্তরালে তাই লুকিয়ে থাকে অনেক ছোট ছোট ভাঙ্গনের ইশারা। সঙ্কটকালের পরিস্থিতিতে কিছু মানুষ সব সময়েই ঘোলা জলে মাছ ধরতে উদ্যোগী হয়; পদে পদে সাধারণ জীবনের ওপর বিঘ্ন নেমে আসে; এই বিঘ্ন থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের ভেতরে ভেতরে ব্যাকুলতা ক্রমেই বিস্তার পায়।
মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তাই বারবার বিপর্যয় নেমে আসে। এই বিপর্যয় জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। তার কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস কিভাবে এক শতাব্দী আগের সময়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়কে মিলিয়ে দেয়, উপন্যাসটির পাঠ তার উদাহরণ হতে পারে।
রিভিউটি লিখেছেনঃ
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।