গ্রন্থ- তারাভরা আকাশের নীচে
লেখক - শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
এই ছবিটি পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ছবি, নিউইয়র্কে "আর্ট অফ মিউজিয়ামে" শোভা পাচ্ছে ছবিটি। শিল্পী ভ্যান গঘের আঁকা #The_Starry_Night , শিল্পের দিক দিয়ে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছবিটি ভীষণ মুল্যবান। দিনের পর দিন চিত্রশিল্প প্রেমী মানুষ যারা এই মিউজিয়ামে পৌঁছতে পারেন, তারা হতবাক হয়ে মুগ্ধ বিশ্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। অথচ একদিন এমন ছিল, যখন শিল্পী হিসেবে ভ্যান গঘ প্রশংসা পাননি, তার ছবি কেউ কেনে না তখন। সেই হিসেবে ভ্যান গঘ ছিলেন চিরদুঃখী শিল্পী, যিনি জীবদ্দশায় তার কাজের স্বীকৃতি পাননি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন।
1853 সালের এক ডাচ অধ্যুষিত গ্রাম! পাদ্রী থিওডোর এবং তার স্ত্রী কর্নেলিয়ার জীবনে বড়ই দুঃখের সময় চলেছে। গতবছর 29 শে জুলাই তাদের এক পুত্র সন্তান হয়েছিল কিন্তু সে মৃত। আবার এই বছর তাদের সন্তান হতে চলেছে। যথারীতি সেই আগের বছরের একই দিনে অর্থাৎ 29 শে জুলাই, 1853 সালে আরো একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হল। গত বছরের মৃত পুত্রের নামেই তিনি এই পুত্রের নাম রাখলেন- ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গঘ। দাদার কবর ছিল বাড়ির কাছেই। সেই কবর দেখতে দেখতে বড়ো হতে থাকে শিশু ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। এরপর আরো সন্তানের জন্ম হয় পাদ্রী থিওডোর এবং কর্নেলিয়ার। কিন্তু ভ্যান গঘ যেন একটু আলাদা রকমের! ছোট ভাই থিও এবং তিন বোনের সঙ্গে খেলাধূলায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে আর অবাক চোখে লক্ষ্য করতে থাকে প্রকৃতির দিকে। কেউ সেদিন জানত না, যে এই শিশুটিই একদিন পৃথিবী বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হবেন।
বারো তেরো বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু তার। ষোল বছর বয়সে স্কুল জীবন শেষ হল। এরপরের দিকে তার কাকা তাকে একটি চাকরি দেন। তাকে চলে যেতে হল লন্ডনে। কিন্তু এমন সময় সমস্যা দেখা দিল। লন্ডনে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেই বাড়ির মালিকের মেয়ের প্রেমে পড়লেন তিনি। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হল। ফলে তীব্র মানসিক আঘাত পেলেন। কাজকর্মে আর তার মন বসল না। ফলে তার চাকরি চলে গেল। শুরু হল তার কঠিন দুঃখময় জীবন। পরের দিকে আবার একটা চাকরি পেলেন। লন্ডনের দরিদ্র ছাত্রদের কাছে বকেয়া আদায়ের ভার পড়ল তার উপর। কিন্তু সেই দুস্থ ছাত্রদের অবস্থা দেখে তিনি নিজেও এতটা দুঃখ পেলেন যে বকেয়া আদায় তার পক্ষে সম্ভব হল না। আবার চাকরি খোয়ালেন তিনি। এরপর তিনি পাদ্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পঁচিশ বছর বয়সে একটি কয়লা খনিতে এলেন পাদ্রী হিসেবে। এখানেও তিনি খনি শ্রমিকদের প্রচন্ড দারিদ্র দেখতে পেলেন। ছবি আঁকতে থাকলেন সেই দারিদ্র্যের। আর নিজের জামাকাপড় পর্যন্ত দান করতে থাকলেন শ্রমিকদের। কিন্তু পাদ্রী গঘের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হলেন কর্তৃপক্ষ। তাই আবার কাজ হারালেন গঘ। এবার বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। এরপর একদিন এক ঘটনা ঘটল। নিজের বাবার সঙ্গে প্রচন্ড তর্কে জড়িয়ে পড়লেন গঘ। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে ক্রিসমাসের দিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু তার হাতে টাকা নেই। সাহায্য চাইলেন ভাই থিওর কাছে। সারাজীবন এই একজনের কাছ থেকেই সহানুভূতি ও সাহায্য পেয়েছিলেন গঘ। তিনি চলে এলেন হাগ শহরে। মন দিয়ে ছবি আঁকবেন ভেবে এখানে এলেন। এখানে এক পতিতার সঙ্গে বাস করতে শুরু করলেন এবং সেই প্রেম এত গভীর হল যে সেই পতিতাকে বিয়ে পর্যন্ত করতে চাইলেন। কিন্তু আপত্তি জানালেন ভাই থিও। শেষ পর্যন্ত বিয়ে হলো না। 1884 সালে আবার দেশে ফিরে এলেন। এখানে এক ছবি আঁকলেন-- এক দরিদ্র কৃষক পরিবার আলু দিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছে। এই ছবিটা পরের দিকে বিখ্যাত হয়েছিল। এবার তার বাবা মারা গেলেন। এবার একেবারে শেষ বারের মত বাড়ি ছাড়লেন। জীবনে আর কখনও তিনি বাড়ি ফেরেননি। ভর্তি হলেন বেলজিয়ামের এক আর্ট একাডেমিতে। কিন্তু বাঁধাধরা জীবন আর ছবি আঁকা তার পছন্দ হলো না। চলে গেলেন প্যারিসে। অনেক শিল্পীর বাস এই শহরে। ছবি আঁকতে থাকলেন সেখানে। কিন্তু অন্যান্য শিল্পীর চক্ষুশূল হয়ে গেলেন। বিভিন্ন মানসিক চাপে জর্জরিত হয়ে অতিরিক্ত মদ খাওয়া শুরু করলেন। দু'বছর পর প্যারিস ছাড়লেন। এলেন আর্লেসে। ততদিনে জাপানী চিত্র শিল্পে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। আর্লেসে তখন শীতকাল। এক বরফ ঢাকা সময়ে এলেন আর্লেসে। এক হলুদ রঙের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। ভীষন পছন্দ হলো এই বাড়িটি। জাপানিদের কাছে হলুদ রঙ বন্ধুত্বের নির্দেশ করেন। এবার বসন্ত এলো আর্লেসে। বহু ছবি আঁকলেন। স্বপ্ন দেখলেন এক নতুন জীবনের। ভাবলেন এমন এক বাসস্থান তৈরি করবেন যেখানে অনেক শিল্পী একসাথে থাকবেন, ছবি আঁকবেন। এক নতুন কলোনি তৈরি হবে, যেটা স্বপ্নের মত সুন্দর! আমন্ত্রণ জানালেন আর এক বিখ্যাত শিল্পী গগ্যাঁ কে। কিন্তু গগ্যাঁ আসতে রাজি হয়নি। শেষে ভাই থিও অর্থ সাহায্য করায় গগ্যাঁ এলেন আর্লেসে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। গগ্যাঁ পছন্দ করলেন না আর্লেস শহর। পছন্দ হলো না গঘের এই ছন্ন ছাড়া জীবন। এমনিতেই শহরের অনেকেই গঘ কে পছন্দ করতেন না। ধীরে
ধীরে গগ্যাঁর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। গঘের এক পতিতা মডেল কে পছন্দ করলেন গগ্যাঁ। সেই মডেলও তাকে প্রশ্রয় দিতে থাকল। গঘ তখন তীব্র মানসিক আঘাতে জর্জরিত, রেগে গেলে একেবারে উন্মাদ হয়ে যেতেন। এক ক্রিসমাসের রাতে গগ্যাঁর দিকে মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন। গ্লাসটি লাগলো না গগ্যাঁর গায়ে। এতেও থামলেন না গঘ। ক্ষুর নিয়ে তেড়ে গেলেন গগ্যাঁর দিকে। পালিয়ে গেলেন গগ্যাঁ। কিন্তু তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে গঘ রাগের চোটে নিজের একটি কান কেটে ফেললেন। কিন্তু এর ফলে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হসপিটালে ভর্তি হতে হলো তাকে। কিন্তু শহরের বিশিষ্ট অনেক ব্যক্তি তাকে আর সহ্য করতে পারলেন না। দাবি করলেন এই পাগলকে তারা শহরে থাকতে দেবেন না। যে শহরকে গঘ এত ভালো বেসেছেন সেই শহর তাকে ছাড়তে বাধ্য করা হলো। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে। কখনও তিনি সুস্থ, তখন ছাড়া পেতেন। আবার অসুস্থ হলেই ভর্তি হতে হতো। এখানে একদিন এক খুশির খবর পেলেন। তার একটা ছবি বিক্রি হয়েছে। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সারা জীবনে তার এই একটি ছবিই বিক্রি হয়েছিল তার। অভঁরো শহরে এবার এলেন। কিন্তু বিকৃত মস্তিষ্কের কারনেও ছবি আঁকা তার বন্ধ হলো না। অজস্র ছবি আঁকলেন। কিন্তু তীব্র হতাশায় ডুবে গেলেন। 1890 সালের 27 শে জুলাই একদিন মেঠো পথ ধরে ঘুরে বেড়ালেন। তারপর রাতে বিছানায় শুয়ে নিজের বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি চালালেন গঘ। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করলেন। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে শেষ হয়ে গেল তার জীবন।
একশো আঠাশ বছর পরেও আজ তার ছবি জগৎ বিখ্যাত। এই শিল্পী জীবিত থাকাকালীন কোন সম্মান বা অর্থ কিছু পাননি। কিন্তু আজ তিনি বহু শিল্পীর প্রেরনা।
আনন্দবাজার শারদীয়া সংখ্যা ১৪২৪ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস #তারাভরা_আকাশের_নীচে । এই উপন্যাস রচিত হয় ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবনের অংশ এবং কলকাতার এক যুবক ঋত্বিক এই দুই চরিত্রের জীবন নিয়ে। শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার ভক্ত আমি, কিন্তু তার লেখা উপন্যাসের সঙ্গে পরিচয় হলো "তারাভরা আকাশের নীচে" র মাধ্যমে। দেখলাম, তার কবিতার মতো উপন্যাসও ভীষণ সুন্দর, সাবলীল। মুগ্ধ হয়ে গেলাম এই উপন্যাস পড়ে। সাধারণত একজন সাধারণ মানের পাঠক হিসেবে দেখেছি, উপন্যাসে কখনো একটি মাত্র চরিত্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, কখনো বহু চরিত্র ঘিরে গোটা একটা বড় উপন্যাস তৈরি হয়, বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু এমন ধরনের উপন্যাস কয়টি আছে, যেখানে দুই চরিত্র বাস করছে পৃথিবীর দুই প্রান্তে, বাসস্থানের দিক দিয়ে তারা একে অপরের থেকে বহুদূরে বাস করে এবং একটি চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের বাস্তবে কোনদিন দেখা হয়নি; অথচ উপন্যাসে তারা দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ! আমার অল্প মানের পড়াশোনার মধ্যে যে সকল উপন্যাস আমি পড়েছি, তার কোনটির মধ্যেই আমি এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাইনি, যা দেখালেন শ্রীজাত বাবু। এই উপন্যাসে এক পর্বে এসেছেন ভ্যান গঘ, তারপর পরের পর্বে এসেছে "ঋত্বিক" নামের চরিত্রটি। এইভাবে এক পর্ব এক পর্ব ছেড়ে ছেড়ে ক্রমানুসারে দুই চরিত্রের জীবনের ঘটনা নিয়ে সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে গল্প । এইরকম সমান্তরাল ভাবে একটা উপন্যাস এগিয়ে নিয়ে যাবার স্টাইল, এটাও আমি আগে কখনো দেখিনি।
উপন্যাসটি শুরু হয়েছে, ভ্যান গঘ বসবাস করছেন আর্লসে, এবং তার আমন্ত্রণ পেয়ে গঁগ্যাঁ চলে এলেন আর্লসে, শীতের রাতে ট্রেন থেকে নামলেন গঁগ্যাঁ..... এখান থেকে শুরু ।
অন্যদিকে ঋত্বিক কলকাতার এক যুবক । সে বর্তমানে এক মানসিক রোগে আক্রান্ত, চোখের সামনে তার ভেসে উঠছে অলীক জগত। চিরপরিচিত মানুষজন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে পরিবর্তে দৃশ্যমান হচ্ছে অন্য এক শহর, অন্য মানুষজন, অলীক এক জগত। এই হ্যালুসিনেশনের মধ্যে বারবার সে নিজেকে আবিস্কার করে ওই "দ্য স্টারি নাইট" ছবিটির মধ্যে। সে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই ছবির সাইপ্রাস গাছের তলদেশে, বাড়িঘর সংলগ্ন এলাকায় বা গির্জায়।
ঋত্বিক চাকরি করে ভালো কিন্তু সে স্বপ্ন দেখেছিল চিত্রশিল্পী হবার। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও ভর্তিও হয়েছিল আর্ট কলেজে, কিন্তু পরের দিকে সেই কোর্স সে ছেড়ে দেয়। তারপর অন্য কোর্স কমপ্লিট করে পরবর্তীকালে একটা ভালো চাকরিও পায়, কিন্তু তাকে বিষন্নতা গ্রাস করে, যার ফলেই তার হ্যালুসিনেশন হতে থাকে। বিষন্ন হবার মতো তিনটি কারণ এখানে খুঁজে পেলাম----
১) তার ছবি আঁকার দিকে অতিরিক্ত আগ্রহ তার বাবা মেনে নেননি। তার মা কিছুটা তাকে সমর্থন করতেন। তাদের পাড়ায় থাকতেন "নলিনী বাবু" নামে একজন মানুষ যিনি ছিলেন একটি আর্ট কলেজের গোল্ড মেডেলিস্ট, পাড়ার সবার কাছে তিনি পরিচিত "ছবি কাকু" নামে। আর্থিকভাবে তিনি ছিলেন অস্বচ্ছল, কয়েকটি ছেলেকে আঁকা শিখিয়ে যেটুকু রোজগার করতেন, তা দিয়েই দিন চালাতেন এই অবিবাহিত মানুষটি। পৈতৃক বাড়িতে ছাদে একটি
মাত্র রুম ছিল তার । কিন্তু তাতে তার কোন ক্ষোভ ছিল না কারো প্রতি। ঋত্বিককে তিনি আঁকতে উৎসাহ দিতেন। আঁকার বই থেকে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখাতেন । সেই বই দেখেই ভ্যান গঘের এই ছবিটির প্রতি আকৃষ্ট হয় ঋত্বিক । নলিনী বাবু তাকে শোনান, ভ্যান গঘের নিদারুণ জীবন কাহিনী । "দ্য স্টারি নাইট" দেখিয়ে বলেন, আমি নিজে এই ছবিটি বাস্তবে দেখার সুযোগ পাইনি। তুই বাস্তবে গিয়ে দেখিস, তুই দেখলেই আমার দেখা হবে। কিন্তু একদিন নলিনী বাবু বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর ঋত্বিকের মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
২) একটি মেয়ের প্রেমেও পড়ে ঋত্বিক, কিন্তু মেয়েটি জানায় সে ইতিমধ্যেই অন্য একজনকে পছন্দ করে । হঠাৎ একদিন ঋত্বিক আবিস্কার করে যে তার নিজের ভাই ওই মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আছে। একদিন বাইরে এক প্রাচীরের গায়ে ওদের দুজন কে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ঋত্বিক ।
৩)ঋত্বিক তার এক বন্ধুর বাড়িতে দুজনে একসাথে ছবি আঁকত। সেই বন্ধু তার ছবি চুরি করে নিজের নামে এক কম্পিটিশনে পাঠায় এবং ছবিটি পুরস্কার লাভ করে ।
তারপর বহু দিন পর অন্য এক মেয়ের সাথে ঋত্বিকের বিয়ে হয়। এই স্ত্রী তাকে ভীষণ ভালোবাসে। এই মানসিক সমস্যার সময় তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে ফের ছবি আঁকতে বলে। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে তাকে নিয়ে যায় নিউইয়র্কের ওই মিউজিয়ামে, তার স্বপ্নের ছবি "স্টারি নাইট" দেখানোর জন্য । ছবিটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঋত্বিক নিজের আবেগের ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।
নিউইয়র্কে এক হোটেলে একাকি অবস্থায় থাকার সময় ভ্যান গঘ আসেন তার সাথে দেখা করতে। অবশ্যই এটা বাস্তব নয়, তার মনের কল্পনা। তাদের দুজনের মধ্যে বেশ কিছু কথাবার্তা হয়।
এরপরের দিকে দেখতে পাই, তার স্ত্রীর অবর্তমানে সে উঁচু ওই ব্যালকনি থেকে নীচে ঝাঁপ দেয়। তখনো সে দেখতে পায় "দ্য স্টারি নাইট" ছবিটাকে, সে যেন চলে যাচ্ছে ওই ছবিটার ভিতর দিয়ে। এখানেই উপন্যাসটি শেষ।
উপন্যাসের এই শেষ পর্বটুকু ব্যক্তিগতভাবে একজন পাঠক হিসেবে আমার ভালো লাগেনি। ভ্যান গঘ জীবনে আত্মহত্যা করেছিলেন, এই ঋত্বিকও সেটাই করল। এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা না ঘটলেই ভালো হত, বলেই আমার মনে হয়। যদি দেখানো যেত, ঋত্বিক সুস্থ হয়েছে, আবার ছবি আঁকছে, তাহলেই আমি বেশি খুশি হতাম। উপন্যাসের প্রতিটি পর্ব অসাধারন লাগার পর একদম শেষ পর্বটা আমাকে স্থির করে দিল। যাইহোক, এটা আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা, খারাপলাগা; এর সাথে বইটিকে তুলনা করছি না। কিন্তু উপন্যাসটি অসাধারন ।
ভ্যান গঘের জীবনকাহিনী লেখক যা বলেছেন, তাতে আমার জানা তথ্যের সাথে সামান্য একটু আধটু ভিন্নতা পেয়েছি। আমি সাধারণ মানের পাঠক, ভ্যান গঘকে নিয়ে পড়াশোনা বিশেষ বেশি কিছু করিনি, হয়ত আমার জানায় অসংগতি থেকে গেছে, যাইহোক উপন্যাস তো "ইতিহাসের বই" নয়, এতে দু একটা বিষয় দ্বিমত থাকলেও কিছু সমস্যা নেই। এত চুলচেরা ইতিহাসের বিচার উপন্যাসে না করলেও চলে।
একটি ঐতিহাসিক চরিত্র এবং একটি বাস্তবচরিত্র সমান্তরাল ভাবে উপস্থাপন করে, এই অসম্ভবের মধ্যেও সম্ভবতার সাযুজ্য স্থাপন করে লেখক যে উপন্যাস লিখলেন তা অসাধারন এবং আমি মনে করি যে সকল উপন্যাস আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছে, "তারাভরা আকাশের নীচে" সেগুলোর মধ্যে একটি। লেখক শ্রীজাত বাবুকে অশেষ ধন্যবাদ এবং শ্রদ্ধা জানাই।
রিভিউটি লিখেছেনঃ ✍ সৌমেশ পাল
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।