📖আদিপর্ব
✍️কৌস্তভ ভট্টাচার্য
📚 দ্য কাফে টেবল
💲২৫০/-
◻️২৪০৩ খ্রিস্টাব্দ। শেষ বিশ্বযুদ্ধের পর তিনশো বছর কেটে গেছে। কিন্তু এক সময়ের সুন্দর নীলগ্রহটা বরাবরের মতো ক্ষতিগ্রস্ত। পৃথিবীর বেশিরভাগটাই এখন মানুষের অগম্য---- শেষ বিশ্বযুদ্ধে যথেচ্ছ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার হলাহলে অভিশপ্ত। এককালের দর্পিত মানবসভ্যতা এখন ম্রিয়মাণ। পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান শক্তিভাণ্ডার, ধর্মীয় বিভেদ আর পারস্পরিক অবিশ্বাস মানুষকে বেঁধে ফেলেছে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে।
ডিস্টোপিয়ার পাঠকের কাছে এই ভবিষ্যতের ছবি নতুন কিছু নয়। সেই কবে অল্ডাস হাক্সলি থেকে জর্জ অরওয়েল, রে ব্র্যাডবেরি থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র---- ডিস্টোপিয়ার দিকনির্দেশ এঁকেছিলেন এই ভাবে। তারপর থেকে অজস্রবার আমরা পৌঁছেছি post apocalyptic বা মহাপ্রলয় পরবর্তী চিরঅন্ধকারের এই ভাবীকালে যেখানে বিজ্ঞান মানুষকে গ্রহান্তরে পৌঁছে দেয়নি কিংবা বিকল্প শক্তির উৎসও এনে দেয়নি, বরং নিজের চিরকালীন স্বভাববশত যুযুধান এবং হিংস্র মানুষ বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত।
কিন্তু কেমন হয় যদি এই ডিস্টোপিয়ার কেন্দ্রে থাকে একটা অতি চেনা শহর, যার গল্প ভারতবর্ষের প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনে আসছে কত সহস্রাব্দ ধরে! ভারতের প্রায় প্রত্যেক শিশুর কানে সেই শহরটার গল্প পৌঁছে যায় কোনো না কোনোভাবে!
শহরটার নাম? হস্তিনাপুর।
'আদিপর্ব'--- মহাভারতের প্রথম পর্বের এই রকমই এক ডিস্টোপিয়ান পাঠ। শান্তনু থেকে সত্যবতী, পরাশর থেকে ভীষ্ম সব অতি চেনা চরিত্ররাই সেখানে উপস্থিত, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর এক অচেনা রূপকল্পে।
মহাকাব্য আর কল্পবিজ্ঞান---- সাহিত্যের দুই সমান্তরাল ধারা এখানে হাত ধরেছে একে অন্যের।
◻️ গতবছর কলেজ স্ট্রিট যেয়ে বইটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল বলে কিনে এনেছিলাম। তারপর আজ পড়বো কাল পড়বো করে এই বইটা Delay-হয়েই চলেছিল, শেষমেশ গত মাসে বইটা শুরু করি এবং 4 পাতা, জাস্ট 4 পাতা পড়েই মনে হয় কেনো বোকার মতো এতোদিন Delay করছিলাম।
◻️দুটো বিষয়কে একসঙ্গে মাখানো হয়েছে এই বইতে - ডিসটোপিয়া আর মহাভারত। ভবিষ্যতের পারমাণবিক যুদ্ধ এবং একটা বিপর্যস্ত পৃথিবী। এ গল্প ঠিক চেনা মহাভারতের গল্প নয়, বরং যুদ্ধক্লান্ত ভারতের গল্প। সেই ভারতে হস্তিনাপুর আছে, পাঞ্চাল আছে, কাশী-গান্ধার-মদ্রও আছে, প্রতীপ,শান্তনু, জাহ্নবী, সত্যবতী, দাশরাজ, পরাশর, জমদগ্নি, দেবব্রত ও বেদব্যাসও রয়েছেন।
◻️ একটা দারুণ ডিসটোপিয়ান লেখা বোধ হয় সেটাই, যেটা মনের মধ্যে ধাক্কা দেয়, ভাবতে বাধ্য করে। যেভাবে সায়েন্স ফিকশনের উপাদানগুলোর মহাভারতের আখ্যানের সাথে, অতীতের সম্পর্কগুলোর ভবিষ্যতের মোড়কের সাথে মিশেল ঘটিয়েছেন লেখক সেগুলো পড়ে তার কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হয়। মহাভারতে অনেকের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে যে ধোঁয়াশা তার একটা বৈজ্ঞানিক রূপ, Human, Humanoid ও Clone-এর যে সমাজগত পার্থক্য তা লেখক সাবলীল ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
◻️আসল মহাভারতে যেমন রাজনীতির ভূমিকা প্রায় পুরোটাই, এখানেও কল্পবিজ্ঞান ছাড়া একটি রাজনৈতিক সাবটেক্সটও রেখেছেন লেখক যা এক কথায় দুর্দান্ত। বিধর্মীদের একঘরে করে দেওয়া, সমাজে স্মীকৃতি না দেওয়া,গণবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিক্ষোভ, ছাত্র-শিক্ষক একত্রে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু বরণের ঘটনা......এই গল্প বিশ্বযুদ্ধের তেজস্ক্রিয়তায় শুকিয়ে যাওয়া এক বিশ্বের। এই গল্প ভবিষ্যত মহাভারতের।
◻️ এবার আসি যে কয়েকটা বিষয় আমার দুর্বল লেগেছে -
১. জাহ্নবীর পরিণতি। আদি মহাভারতের জাহ্নবী তথা গঙ্গা এমনিতেই আমার খুব পছন্দের চরিত্র এবং এখানে লেখক জাহ্নবীকে যেভাবে রচনা করেছেন নিঃসন্দেহে 'আদিপর্ব'-তে সে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় চরিত্র বলাই যায়। কিন্তু মনে হলো তার ওরকম পরিণতি যেন চরিত্রটিকে দুর্বল করে দিলো।
২. পরাশর, পরশুরাম, দেবব্রত ও বেদব্যাসের চরিত্রগঠন দুর্বল মনে হয়েছে, আরো Strong Storyline থাকতেই পারতো। যদিও শেষ তিনজনের আরো চারিত্রিক উন্নতি পরবর্তী পর্বে দেখতে পাওয়ার আশা করাই যায়।
◻️বইটা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলব, সেটা হল লেখার সাবলীলতা। রাজনৈতিক সাবটেক্সট হোক বা আদি মহাভারতের রেফারেন্স, কল্পবিজ্ঞানের উপাদান হোক বা চরিত্রদের মধ্যের সম্পর্ক....প্রতি পদে চমক উপস্থিত। পাঠ প্রতিক্রিয়া শেষ করি লেখকের প্রতি একটি প্রশ্ন দিয়েই - "বলছি পরবর্তী পর্ব কবে আসছে?? বেশী অপেক্ষা করালে কিন্তু ভালো হবেনা।"
রিভিউটি লিখেছেনঃ Monolina Sengupta
আপনিও লিখতে পারেন রিভিউ। বিস্তারিত দেখুন এখানে।